শয়তানের পরিচয়_____
মেজাজী বা রুপক শয়তানের পরিচয় ও ব্যাখা আগেই দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা হাকিকী শয়তান তথা আসল শয়তানের পরিচয় ও ব্যাখা সামান্য দিতে চাই। হাকিকী শয়তান তথা আসল শয়তান, পবিত্র কোরান অনুসারে, চার প্রকারঃ ইবলিশ, শয়তান, মরদুদ এবং খান্নাস। এই চার প্রকার শয়তানকে আল্লাহ্পাক মাত্র দুইটি স্থানে থাকবার অনুমতি দিয়েছেন। এই দুইটি স্থান ছাড়া শয়তানকে আর কোথাও থাকবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। যে দুইটি নির্দিষ্ট স্থানে এই চারটি শয়তানকে থাকবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেই স্থান দুইটির নাম হলঃ জিনের অন্তর আর মানুষের অন্তর। জিনের অন্তর আর মানুষের অন্তর ছাড়া এক পা-ও বাহিরে যাবার ক্ষমতা শয়তানের নাই। সুতরাং জিনের অন্তর এবং মানুষের অন্তর ছাড়া এই চারটি শয়তানের আর কোন বিন্দু মাত্র স্থান নাই।
আকাশ হতে শয়তানেরা যে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে থাকে তথা ফেলতে থাকে, উহা পৃথিবীর আকাশ নহে, বরং প্রতিটি মানুষের মনের আকাশ। এই মনের আকাশ হতেই শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার তরে, দিশেহারা করার তরে, বিপথে নেওয়ার তরে, অনবরত আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। চরম সত্যে মানুষের মনের আকাশে শয়তান যে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে, ইহাই শয়তানের ডিউটি। মানুষ দুনিয়াই চায়, না আল্লাহ্কে চায়, এই পরীক্ষা করার জন্যই এহেন আগুনের গোলা নিক্ষেপের কথাটি আসে। যদি পরীক্ষা করার কথাটি না থাকত তাহলে মনের আকাশে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করার প্রশ্নই উঠতো না। সুতরাং শয়তান বাহিরে থাকে না, থাকবার বিধান নাই। দুধ আর মাখন যেভাবে দুধের সাথে জড়িয়ে থাকে, এবং দুধের ভেতর যে মাখন আছে ইহা বুঝবার উপায় থাকে না, সে রকম মানুষের অন্তরে যে শয়তান অবস্থান করছে ইহাও বুঝবার উপায় থাকে না। সুতরাং প্রতিটি মানুষ মনে করে সে একা, কিন্তু আসলে সে মোটেও একা নয়। যেহেতু প্রতিটি মানুষের সাথে শয়তানকে পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে সেই হেতু মানুষ দুইজন, অনেকটা একের ভেতর দুইয়ের মত। কিন্তু ইহাও সত্য নয়। কারণ জীবাত্মার সাথে খান্নাস রুপী শয়তান পাশাপাশি অবস্থান করছে, সে রকমভাবে আরেকজন অবস্থান করছে। সেই আরেকজনের নাম হল তথা পরমাত্মা তথা স্বয়ং আল্লাহ্। তাই প্রতিটি মানুষের শাহা রগের নিকটেই আল্লাহ্ আছেন বলে ঘোষণাটি দেখতে পাই। অন্য কোন জীব-জানোয়ারের শাহা রগের নিকটে আল্লাহর অবস্থানটির কথা কোরানে পাইনা। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে, যেহেতু জীন নিয়ে আমাদের কোন কাজ কারবার নাই, তাই আমরা ইচ্ছা করে জীন বিষয়টিকে বাদ দিলাম, যদিও জীন এবং মানুষকেই আল্লাহ্র ইবাদত করার কথাটি বলা হয়েছে। সমস্ত সৃষ্টিরাজ্য আল্লাহ্র ইবাদতে ডুবে আছে, তাই ইবাদত করার আদেশ দেবার প্রশ্নই আসে না। যেহেতু মানুষ এবং জীনকে সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দেওয়া হয়েছে, সেহেতু ইবাদত করার আদেশটি প্রযোজ্য।
যখন শয়তান অহংকার করে তখন শয়তানের রুপটির নাম হল ইবলিশ। ‘বালাসা’ শব্দটির অর্থ হল অহংকার। ইহা হিব্রু ভাষা, আরবি ভাষা নয়। বালাসা তথা অহংকার শব্দটি বিশেষ্য তথা নাউন, ইবলিশ তথা অহংকারী শব্দটি বিশেষণ তথা এডজেকটিভ। সুতরাং শয়তানের আদিরুপ ইবলিশ তথা অহংকারী। কারণ, আদমকে সেজদা দেবার হুকুমটি সরাসরি অমান্য করার দরুন সে অহংকারী হয়ে গেল, তথা ইবলিশ হয়ে গেল। তাই ইবলিশই হল শয়তানের প্রথম এবং আদিরুপ।
মানুষ জীবন ধারণের প্রশ্নে যখন বিভিন্ন প্রকার লোভ-লালসার খপ্পরে পড়ে যায় এবং জীবন ধারণের প্রশ্নে বৈষয়িক বিষয়ের ঘাত প্রতিঘাতের আঘাতে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হতে থাকে, সেই আঘাত খাওয়া অবস্থানটির নাম শয়তান। তাই পবিত্র কোরানের যেকোন সুরা পাঠ করার আগে আমাদের বলতে হয় যে, পাথরের আঘাত খাওয়া শয়তান হতে আশ্রয় চাই। হাজীরা যে শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারে সেই মেজাজী বা রুপক বিষয় হতেই হাকিকি বা আসল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ বুঝতে পারে, কেউ পারেনা। বোঝাটাও তক্দির, না বোঝাটাও তক্দির। সুতরাং চরম পর্যায়ে, আল্লাহ্র সৃষ্টির মাঝে বিন্দুমাত্র ভুলের অবকাশ নাই। ইহাই পবিত্র কোরানের পবিত্র সুরা মুলকে বলা হয়েছে। কেউ বোঝেন, কেউ বোঝেন না। বোঝাটাও তক্দির, না বোঝাটাও তক্দির। তক্দিরের বলয় হতে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত ছাড়া বেরিয়ে আসা অসম্ভব। জিন এবং মানুষের অন্তর ছাড়া অন্য কোথাও শয়তানের অবস্থানটির কথা যদি অন্য কোথাও আছে বলে কেউ লিখে তো ধরে নিতে হবে যে, সে ইসলামের বিন্দু-বিসর্গও জানে না, কেবল হাউকাউ করে বড় বড় কথার ফুলঝুরি ছড়ায়ে, আরবী ব্যাকরণের তেলেসমাতি দেখিয়ে সরল মানুষগুলোকে লিখনীর মাধ্যমে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা করে তুলেছে।
যে মানুষটি কেবলমাত্র দুনিয়াই চায় এবং যার দুনিয়া চাওয়া ছাড়া আর কোন চাওয়াই থাকেনা, তাকে মরদুদ বলা হয়। মরদুদের স্থান হাবিয়া দোজখ। হাবিয়া দোজখের তলা থাকে না। যে মানুষটির দুনিয়া চাওয়ার সীমা থাকে না সেই মানুষটিকে তলা ছাড়া হাবিয়া দোজখে যেতে হয়। এই মরদুদ শব্দটি কোরানে কয়েকবার পাওয়া যায়।
যে শয়তান সর্ব বিষয়ে সর্ব ঘটনায় পিছু পিছু কুমন্ত্রণা দিতে থাকে তার নাম খান্নাস। শয়তানের এই খান্নাস রুপটি ভয়ংকার এবং বিপদজনক। তাই খান্নাসের কুমন্ত্রণা হতে পবিত্র কোরান মুক্তি চাইবার উপদেশ দিয়েছেন। অবাক লাগে যে, শয়তানের এই খান্নাস রুপটি এত ভয়ঙ্কর অথচ সমগ্র কোরানে মাত্র একবার উল্লেখ করা হয়েছে। কাউসার শব্দটি এবং আহাদ শব্দটি সমগ্র কোরানে মাত্র একবার উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি খান্নাস শব্দটিও একবার উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এই তিনটি শব্দের মাঝে গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। এই তিনটি শব্দের অর্থ ব্যাকরণ দিয়ে মোটামুটি ধারণা জন্মাতে পারে, কিন্তু গভীর রহস্য অনুধাবণ করতে হলে হৃদয় দিয়ে গবেষণা করতে হয়।
সুতরাং পরিশেষে আবার একই পুরোনো কথাটি বলতে চাই যে, জিন এবং মানুষের অন্তর ছাড়া শয়তানের থাকার আর একটি স্থানও নাই। এই খান্নাস রুপী শয়তানটি, যাহা প্রতিটি মানুষের অন্তরে অবস্থান করছে, উহাকে তাড়িয়ে দেবার বহু প্রকার উপদেশের আরেক নাম কোরান। যত প্রকার মোরাকাবা, মোশাহেদা, ধ্যানসাধনা, এবাদত-বন্দেগী, কান্না ও বিলাপ, নফ্সকে ইচ্ছা করে নানা প্রকার কষ্ট প্রদান করা, সবই এই খান্নাস রুপী শয়তানকে তাড়িয়ে দেবার একমাত্র উদ্দেশ্য। আর দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য নাই আর থাকার কোন বিধান রাখা হয় নাই। তাই পবিত্র কোরানের সুরা মোমিনের ষাট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মানুষ, তুমি একা হও এবং একা হয়ে আল্লাহ্কে ডাক দাও, তাহলে ডাকের জবাব সঙ্গে সঙ্গে পাবে। আরবী ভাষায় দুইজন ডাক দিলে বলা হয় উদ্উনা, আর একজনে ডাক দিলে হয় উদ্উনি। কোরান উদ্উনি তথা একা শব্দটি ব্যবহার করেছে। উদ্উনা তথা দুইজন থাকলে ডাকের জবাব পাওয়া যাবেনা। আমি এবং খান্নাস রুপী শয়তান মিলে দুইজন। কারণ, খান্নাস রুপী শয়তান বাহিরে থাকেনা, বরং আমার অন্তরেই অবস্থান করছে। সুতরাং আমরা দুইজন। এই দুইজন থাকলে আল্লাহ্ ডাকের জবাব দেননা। এই দুইজনের অবস্থানটিকেই উদ্উনা বলা হয়। খান্নাস রুপী শয়তানকে তাড়াও এবং তাড়াতে পারলে তুমি একা হবে এবং একা হলে ডাকের জবাব সঙ্গে সঙ্গে পাবে। ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি (রাঃ) জাবরুত মোকামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘রব্ (আল্লাহ্), আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। রব্ বললেন, ‘বায়েজিদ তুমি মিথ্যুক’। কেননা যদি তুমি সত্যিই সন্তুষ্ট থাকতে তাহলে সন্তুষ্ট থাকার কথাটি বলতে না। বায়েজিদ লজ্জায় মাথা নত করে পুনরায় কঠোর ধ্যান সাধনায় মগ্ন রইলেন। এভাবে দুই বৎসর ধ্যান সাধনায় মগ্ন থাকার পর বায়েজিদ একদিন বলে ফেললেন, ‘আমিই ভাসমান সত্ত্বা, সব শান আমারই’।(আনা সুবহানি মাআজামু শানি)। লা মোকামে প্রবেশ করতে পারলেই এমন কথা বলা যায়। সুতরাং নাসুত, মালাকুত ও জাবরুত মোকামে সাধককে পীরের ধ্যানটি করতেই হবে এবং কোন রহস্যজনক ব্যাপার দেখতে পেলে আপন পীরের রুপেই দেখা যায়। কিন্তু সাধক যখন লা মোকামে প্রবেশ করেন তখন দেখতে পান, আপন পীর ডান দিক দিয়ে চলে গেছেন এবং বাম দিক দিয়ে খান্নাস রুপী শয়তানটি ভেগে গেছে। তখনি সাধক নিজের মধ্যে দেখতে পান যে, তাঁর পীরও তিনি, তাঁর মুরিদও তিনি। এখানেই তৌহিদ। সুতরাং পীর ধরাও শেরেক, কিন্তু ইহাই শেষ শেরেক। সুতরাং আপন পীরের অবস্থানটি জাবরুত মোকাম পর্যন্ত। লাহুত মোকামে পীর আর থাকেনা। সুতরাং লাহুত মোকামে সাধক যখন প্রবেশ করেন তখন দেখতে পান যে, আপন পীরের আধ্যাত্মিক মূল্য আর এক টাকাও নয়। সুতরাং আপম পীরের অবস্থানটি তিনটি মোকাম পর্যন্ত। লাহুত মোকামে প্রবেশ করলেই পীর আর থাকেন না এবং পীরের দাম আর এক টাকাও নহে। এই কথা গুলো উচু স্তরের নীতিনির্ধারণের কথা। তাই অনেকের ভুল বোঝার সম্ভবনাটি থেকে যায়। এখানে পীর ধরাটা মূখ্য বিষয় নহে, মূখ্য বিষয়টি হল আল্লাহ্র তৌহিদ সাগরে অবগাহন করা।
-মারেফতের বানী
-- চেরাগে জান শরীফ ডা. বাবা জাহাঙ্গীর আল সুরেশ্বরী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন